নোমোফোবিয়া: বাংলাদেশের তরুণ সমাজে এক নীরব মানসিক মহামারি

0 Shares

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে মোবাইল ফোন। এটি আমাদের যোগাযোগ, শিক্ষা, বিনোদন এবং তথ্যভাণ্ডারের মূল কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। তবে এই প্রযুক্তি-নির্ভরতা যখন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে দাঁড়ায় এবং মোবাইল ফোন ছাড়া থাকার আতঙ্ক সৃষ্টি করে, তখন তা রূপ নেয় এক ধরনের মানসিক ব্যাধিতে। এই মানসিক অবস্থার নামই নোমোফোবিয়া (Nomophobia)। “Nomophobia” শব্দটি এসেছে “No Mobile Phone Phobia” থেকে, যার অর্থ মোবাইল ফোন না থাকলে বা ব্যবহার করতে না পারলে সৃষ্ট তীব্র মানসিক অস্বস্তি বা আতঙ্ক। এটি কোনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত মানসিক রোগ না হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর ব্যাপকতা মানসিক স্বাস্থ্য গবেষকদের বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।

বাংলাদেশে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের হার বিগত এক দশকে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (BTRC) সর্বশেষ তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি ছাড়িয়ে যাবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, এমনকি গৃহবধূরাও দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। তরুণ সমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা যায়, মোবাইল ফোন থেকে সামান্য সময়ের জন্য বিচ্ছিন্ন থাকলেও তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, হতাশাগ্রস্ত বোধ করছে, এমনকি প্যানিক অ্যাটাকের মতো লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। ক্লাসে মনোযোগ না দেয়া, রাতে ঘুমের ব্যাঘাত, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি- এসবই নোমোফোবিয়ার বহিঃপ্রকাশ।

নোমোফোবিয়ার সম্ভাব্য খারাপ পরিণতিঃ   

  1. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি: দীর্ঘমেয়াদে উদ্বেগ (anxiety), বিষণ্ণতা (depression), এবং নিদ্রাহীনতা (insomnia) দেখা দিতে পারে।
  2. একাকীত্ব ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: বাস্তব জীবন থেকে দূরে সরে গিয়ে ভার্চুয়াল জগতে বাস করার প্রবণতা বাড়ে, যার ফলে সামাজিক দক্ষতা কমে যায়।
  3. আগ্রহহীনতা ও কর্মক্ষমতার অবনতি: পড়াশোনা বা কাজের প্রতি আগ্রহ কমে যায়; প্রোডাক্টিভিটি কমে যায়।
  4. তীব্র আসক্তি ও আক্রমণাত্মক আচরণ: ফোন না পেলে বা নিষিদ্ধ করলে ব্যক্তি বিরক্ত, রাগান্বিত বা হিংস্র আচরণ করতে পারে।
  5. সড়ক দুর্ঘটনা বা দৃষ্টি সমস্যা: মোবাইল ব্যবহারের সময় রাস্তায় হেঁটে চলা বা গাড়ি চালানোর ফলে মারাত্মক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে।

যেভাবে এই আসক্তি থেকে মুক্তি মিলতে পারেঃ

নোমোফোবিয়া থেকে মুক্তি পেতে হলে আত্মনিয়ন্ত্রণের চর্চা এবং জীবনধারায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আনা আবশ্যক:

  1. ডিজিটাল ডিটক্স প্র্যাকটিস করুন: প্রতিদিন নির্দিষ্ট কিছু সময় ফোন ছাড়া কাটানোর চেষ্টা করুন (যেমন, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম এক ঘন্টা ফোন থেকে দূরে থাকা)।
  2. অ্যাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যবহার করুন: স্ক্রিন টাইম পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন অ্যাপ যেমন Digital Wellbeing বা Forest ব্যবহার করুন।
  3. ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও সামাজিক বন্ধন জোরদার করুন: পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি সময় কাটানোর গুরুত্ব বাড়ান।
  4. মনোযোগ ধরে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলুন: ধ্যান (meditation), বই পড়া, বা নতুন কোনো সৃজনশীল কাজে নিজেকে যুক্ত রাখুন।
  5. পেশাদার সাহায্য নিন: আসক্তির মাত্রা অতিরিক্ত হলে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করুন।

নোমোফোবিয়া বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক সুপ্ত বিপদের নাম। এটি শুধু একটি সাময়িক অভ্যাস নয়, বরং একটি মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, যা ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজের ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার, প্রযুক্তি ব্যবহারে ভারসাম্য আনার এবং মানসিক সুস্থতার দিকে মনোযোগী হওয়ার। স্মরণ রাখা জরুরি প্রযুক্তি আমাদের সাহায্য করার জন্য, আমাদের দাস বানানোর জন্য নয়।

What’s your Reaction?
+1
1
+1
0
+1
0
+1
0

About The Author

0 Shares
Copy link